(১)
“আমি শাহবানু মুসলিম মেয়ে, তবু ইসলাম আমাকে দেখে না! আমার জন্য হাদিস কেউ না, শরিয়ত তুমি এত নিষ্ঠুর”
পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় পরিবারতন্ত্রে - আর নারীকে শৃঙ্খলিত রাখার মধ্যে তার বিস্তার। নারী জন্মসূত্রে অবলা, পুরুষের পর জন্মেছিল নারী। উত্তরাধিকার উৎপাদনে নারী গণ্ডিবদ্ধ গৃহজীবনে হয়ে ওঠে পরিচারিকা। সমান অধিকার যে নারীর স্বাভাবিকভাবেই প্রাপ্য এবং কোনোভাবেই তা পুরুষের দেওয়ার জিনিস নয়, এই সারসত্যটা আমাদের সমাজ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। উপরন্তু নারীকে বোঝানো হয়েছে পুরুষের আজ্ঞাবাহী হওয়াটা তাদের অবশ্যকর্তব্য। ঘরের কাজ-বাইরের কাজ, এই শ্রেণিবিভাগটাও একান্তভাবেই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ফসল। তবে এই প্রপোগেণ্ডা এখন মিথে পরিণত। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মনে করে যে, তারা নারীকে সমান অধিকার দিয়ে থাকে। এবং একই সাথে কয়েক হাজার বছর ধরে মেয়েদের মাথায় ঢোকানো হয়েছে যে, তারা আদতে ‘ইনফিরিয়র ক্লাস’ এবং পুরুষের আজ্ঞাবাহী হওয়াটা তাদের অবশ্যকর্তব্য। ধর্ম থেকে সামাজিক জীবন, যাবতীয় শেকল মেয়েদের জন্যই সৃষ্টি। ঘরের কাজ-বাইরের কাজ, এই শ্রেণিবিভাগটাও একান্তভাবেই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ফসল।
ভারতবর্ষের সামাজিক, জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক আন্দোলন এসে মিশেছিল নারী প্রগতি আন্দোলনের মোহনায়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতবর্ষে মহিলাদের অবস্থার খুব একটা হেরফের হয় না। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই বঞ্চনা মিটিয়ে কীভাবে মেয়েদের সমান অধিকার দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করা যেতে পারে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের ডামাডোলে প্রতি এগারো মিনিটে একজন মহিলা খুন হচ্ছেন নিজের ইন্টিমেট পার্টনার অর্থাৎ স্বামী, বাবা, ভাই দ্বারা। হচ্ছে কন্যা ভ্রূণ হত্যাও। ভারতবর্ষে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থান দলিত আর সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলিম মহিলারা।
মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থার অবনতি হয়েছে চতুর্দশ শতাব্দীতে ফিরোজ তুঘলক (১৩৫১) থেকে সিকান্দার লোদীর (১৪৮৯-১৫৭৭) সময়কালে। কারণ নারীদের ধর্মীয় পবিত্র স্থানে যাওয়ার স্বাধীনতাও ছিল না, এমনকি বোরখা ছাড়া মেয়েদের চলাফেরা সর্বাবস্থায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। একদা ‘অবাঙালি মুসলমানদের পোশাক’ বলে চিহ্নিত যে আচ্ছাদন আপামর বাঙালি মুসলিম মেয়েদের কাছে ব্রাত্য ছিল – সেই হিজাব, বোরখার ‘বাঙালি’ দোকান এখন গজিয়ে উঠেছে। কারণ হিসাবে মূলত দুটো মত উঠে আসে – প্রথমত ধর্মীয় ভক্তিরসের প্রাধান্য এবং দ্বিতীয়ত পশ্চিমা ফ্যাশনের সাথে পশ্চিম-বিরোধী ইসলামিক সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা। মূলত পাশ্চাত্যে উদ্ভূত ব্যক্তিস্বাধীনতাকামী ও নারীবাদী স্লোগান ‘মাই বডি-মাই চয়েস’ -কে বুমেরাঙের মত ব্যবহার করছে এই পর্দাসীন মেয়েরা।
নিজস্ব ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থানে পিছিয়ে থাকার জন্য মুসলিম কম্যুনিটিতে মেয়েদের অবস্থার প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি এখনও। মুসলমান মেয়েদের পিছিয়ে থাকার কারণ খুঁজতে গেলে ভিতরে ও বাইরে - অর্থাৎ তাদের পরিবারের ভিতরে ও সমাজে – দু জায়গাতেই দৃষ্টি দিতে হবে। মুসলমানদের বেশিরভাগই গ্রামে বসবাস করায়, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মতোই মুসলমান মহিলারা সকল রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। চাষবাস বা অন্যান্য শারীরিক শ্রমনির্ভর জীবিকা, সাক্ষরতার নীচু হার ও দুর্বল স্বাস্থ্য পরিষেবার কারণে মুসলমানদের মধ্যে নানা বিষয়ে অক্ষমতা দেখা দেয় ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। নিজ সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই এক শ্রেণীর মানুষ মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা, অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে। বাড়ির মেয়েরা পড়াশুনা বা কাজের জন্য বাইরে যাবে কেন- এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে অশান্তি লেগেই থাকে। এই কারণেই বহু মুসলিম কিশোরীর অসম্ভব প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় মুসলমান পরিবার গুলোতে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। ফলে শিশুরাই শিশুর মা হয়ে যাচ্ছে। শারীরিক গঠন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে মা ও শিশু কারোরই পুষ্টি ঠিকঠাক হয় না এবং তারা স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে। জাস্টিস রাজিন্দার সাচারের নেতৃত্বাধীন কমিটি ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে কিছু নগ্ন সত্য বেরিয়ে আসে। ৬-১৪ বছর বয়সী বাচ্চাদের গ্রুপে ২৫% মুসলিম শিশু স্কুল থেকে ড্রপ আউট হয়। মাত্র ১৭% মাধ্যমিক পাশ করে। সরকারি স্কুল রিপোর্টকার্ড (২০১৪-১৫) অনুযায়ী, গড়পড়তা ৫০% মুসলিম মহিলা স্কুলে গিয়ে থাকে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ এই রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায় -- ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভের মধ্যে প্রায় ৪০% মুসলিম মেয়ে স্কুল থেকে ড্রপ আউট হয়। এবং এই ড্রপ আউট সবচেয়ে বেশি হয় মাধ্যমিকের পর। অর্থাৎ, মাধ্যমিক পাশ করার পর অধিকাংশ মুসলিম মেয়ে আর পড়ার সুযোগ পায় না।
২০১১-এর সেন্সাস অনুযায়ী, আমাদের দেশে ১৪.২৩% মানুষ ইসলাম ধর্মের। এর আগে সাচার কমিটি রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় মুসলিমদের ৩১% পভার্টি লাইনের নিচে বাস করে। মোট মুসলিম কম্যুনিটির ৪৮% হল মহিলা আর সেন্সাস ২০১১-তে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের ৪৮.১১% নিরক্ষর। অর্থাৎ প্রায় চার কোটির বেশি ভারতীয় মুসলিম মহিলা নিজের নামটাও লিখতে পারেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অবস্থান মোটেই উল্লেখ্য নয়।
২০০৪-০৫ সালে সাচার কমিটি রিপোর্ট মতে, মোট জনসংখ্যার ৪.৪% মুসলিম যুবক গ্রাজুয়েশন পড়তে যায়। ২০০৯-১০ সালের স্যাম্পল সার্ভেতে সংখ্যাটা একটু বেড়ে হয় ১১%। ২০১৩-১৪-তে উচ্চশিক্ষায় মুসলিম যুবক-যুবতীদের অংশগ্রহণ বেড়ে হয় ১৮% এবং ২০১৮-তে তা ৩৭%-এ দাঁড়িয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক একজন অশিক্ষিত এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল মানুষ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবেন না। ইউনেস্কো EMPOWERMENT-এর সংজ্ঞা দিচ্ছে, “… the expansion of assets and capabilities of poor people to participate in, negotiate with, influence, control, and hold accountable institutions that affect their lives.”। অর্থাৎ, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একজন মানুষের ক্ষমতাহীন থেকে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার পদ্ধতিটাকেই আমরা এমপাওয়ারমেন্ট বলছি। মহিলাদের ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্য হল এমন একটি আদর্শ সমাজ সৃষ্টি করা যেখানে মহিলারা সবরকম অত্যাচার আর বঞ্চনার হাত থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের মত বাঁচতে পারবেন।
আমাদের দেশে যেখানে মেয়েদের পায়ে শেকল বেঁধে রাখাটাই দস্তুর সেখানে উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের মত স্বাধীন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করাটা অবশ্যই খুব শক্ত কাজ।আর্টিকেল ১৫-তে বলা হয়েছে যে, সরকার লিঙ্গের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করতে পারবে না। আর্টিকেল ১৫ (A) আর (E)-তে মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণকে শাস্তির আওতায় ফেলা হয়েছে। ২০০১ সালে National Policy for The Empowerment of Women বিলটি পাশ করানো হয়।
ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের ২০০০ সালের রিপোর্টে শহর এলাকায় ৬.০৩% আর গ্রামে মাত্র ১.২২% গ্রাজুয়েট মুসলিম মহিলা পাওয়া গিয়েছিল। তবে গত দেড় দশকে এই অবস্থার খানিক হলেও পরিবর্তন ঘটেছে। All India Survey on Higher Education (২০১৭-১৮)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত পাঁচ বছর উচ্চশিক্ষায় মুসলিম মহিলাদের এনরোলমেন্ট বেড়েছে ৪৬%, যা অত্যন্ত ইতিবাচক।
(২)
সার্বিকভাবে মুসলিম নারীর লেখাপড়ার সুযোগ বেড়ে গেলেও শরিয়ত, পর্দা ও ধর্মীয় কুসংস্কারে মুসলিম নারী এখনও পুরুষতন্ত্রের গেঁড়াকলে। সেই জায়গা থেকে বেগম রোকেয়ার কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল সত্য। পিছিয়ে থাকা নারী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি তার বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তমসাবৃত অবস্থা থেকে আলোর অভিমুখী করেছিলেন নারীকে। তাই প্রগতি চেতনার দিশারী, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া প্রথমেই বিদ্রোহ করেন পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। আর তাঁর লেখনী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ‘ধারাবাহিক ধর্মযুদ্ধ’। মুসলিম সমাজে নারী জাগরণে, সমস্ত প্রগতিশীল ভাবনার এক সংহত রূপ সংগ্রামী নারী বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্মধারায় প্রকাশ পেয়েছে।
'ইসলামে নারী হল মূর্তিমতী কাম। যে নারী একদিন তাকে করেছিল স্বর্গভ্রষ্ট, লিপ্ত করেছিল পাপ কাজে, তাই তাকে অর্থ্যাৎ নারীকে ইসলাম ক্ষমা করেনি কোনদিন। কোরানের চতুর্থ সুরা- ‘সুরা নিসা’। ‘নিসা’ শব্দের অর্থ নারী। সুরার নামকরণ থেকে বোঝা যায় এখানে নারীর বিধি-বিধান-নির্দেশ উপদেশ তুলে ধরা হয়েছে। এখানে নারীর সম্পত্তির অধিকারের কথা বলা হয়েছে। যদিও তা যৎসামান্য। এই সুরা যদিও নারীর জন্য রচিত তবুও কিন্তু এখানেও কোরানের স্রষ্টা পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়েছে--- “পুরুষ নারীর রক্ষা কর্তা। কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন, আর এজন্য যে, পুরুষরা তাদের ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে।”(সুরা নিসা, ৪/৩৪)
আবার বলা হয়েছে - “নারীদের পরিচালক হচ্ছে পুরুষরাই। কারণ, আল্লাহ তাদের মধ্যে অন্যের উপরে মর্যাদা দান করেছেন। (সুরা নিসা, ৬/৩৪)
ইসলাম ধর্ম পুরুষকে করেছে বহুভোগ্যা। সুরা নিসার প্রথমে আল্লাহ বলে দিলেন -- “তবে বিয়ে করবে (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার জনকে। আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকে বা তোমাদের অধিকার ভুক্ত দাসীকে। এভাবেই তোমাদের পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভবনা বেশি।” (সুরা নিসা, ৪/৩) এমনকি নারী অবাধ্য হলে তাকে প্রহার করার কথাও কোরানে বলা হয়েছে -- “স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে ভাল করে উপদেশ দাও, তারপর তাদের বিছানায় যেওনা ও তাদেরকে প্রহার করো। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ খুঁজবে না।” (সুরা নিসা ৪/৩)
যদিও আবার অনেকে মনে করেন - “ইসলামই প্রথম ঘোষণা করল, পুরুষের ন্যায় নারী জাতিরও আছে স্বাধীনতার অধিকার, মুক্তির অধিকার। শিশু কন্যার আছে বাঁচার অধিকার। বিধবার আছে বিবাহ করার পূর্ণ অধিকার। কুমারীর আছে স্বামী পছন্দের সম অধিকার। পুরুষের ন্যায় মহিলারও আছে বিবাহবিচ্ছেদে সমান দাবী৷ আইনের সম অধিকার। পাপ ও পুণ্যের সম অধিকার। আরধনা ইবাদতে সম অধিকার। শিক্ষাতে সম অধিকার। নারী মনুষ্য সমাজের অর্ধেক, তার দাবিও অর্ধেক। এই পৃথিবীতে পুরুষের প্রয়োজন যতটা, নারীর দরকারও ততটাই। একটি পরিবারের এক পা, এক হাত, এক চোখ, এক কান যুবকের, দ্বিতীয় গুলোর মালিক যুবতী৷ ইসলাম ঘোষণা করল, এই পৃথিবীতের সমস্ত কিছুতেই নারীর প্রকৃতিগত, প্রবৃত্তিগত, স্বভাবগত, এবং যা কিছুই তার সহজাত, সর্বস্থানেই পুরুষের সঙ্গে তার সম অধিকার আছে। সমগ্র মানবমন্ডলীর অর্ধাংশকে প্রথম মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিল কে, ইসলাম।পুরুষের পুংলিঙ্গের নিকট নারীর স্ত্রী লিঙ্গ তো কোনদিনই লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কেবল প্রয়োজন-অপ্রয়োজন যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ইসলামই তাকে সম-স্থান, সমসম্মান দিল।"
আরব্য রজনীর অংসখ্য উপাখ্যানে দেখা যায় পুরুষ এক নারী থেকে অন্য নারীতে ছুটেছে, এক নারীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি- যাকে ইসলাম আদর্শরূপে গ্রহণ করেছে। তাই ইসলামের কাছে বিয়ে একটা অসম চুক্তি, একটা প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর জন্য একজন মুসলমান পুরুষ চারজন বৈধ স্ত্রী রাখার পরও যৌন সম্ভোগের জন্য যত খুশী দাসীকে সম্ভোগ করতে পারে, তাতে ইসলামী আইনে বা নৈতিকতায় কোন বাধা নেই। দাসী সম্ভোগ ইসলামে বৈধ। বিয়ে সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন -- ‘‘ইসলামি আইনে বিয়ের চুক্তি মালিক-শ্রমিকের চুক্তির থেকেও ভয়াবহ ও শোষণমূলক, কেননা ওখানে চুক্তি করে’ই একজনকে দেয়া হয় অশেষ অধিকার এবং আরেকজনের প্রায় সমস্ত অধিকার বাতিল হয় কিছু সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে। ইসলামি আইনে স্ত্রী হচ্ছে চুক্তিবদ্ধ দাসী, যে স্বামীকে দেবে যৌনতৃপ্তি ও বৈধ সন্তান। কিন্তু স্বামী যখন ইচ্ছে মনের খেয়ালে শুধু তিনবার ‘তালাক’ বলে ছেড়ে দিতে পারবে তাকে। চুক্তির কথা বলা হলেও ইসলামি বিয়েতে পুরুষ ও নারীটি চুক্তিতে আসে না, চুক্তিতে আসে পুরুষ ও নারীর অভিভাবক।”
আবার তিনি বলেছেন - ইসলামে বিয়ে যেহেতু চুক্তি, তাই তা চিরস্থায়ী নয়, যে-কোনো সময় স্বামী তা বাতিল করতে পারে। তালাক মুসলমান নারীর জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর শব্দ, ওই বজ্ৰ যে- কোনো সময় নীলাকাশ থেকে তার মাথায় এসে ফাটতে পারে। মুসলমান পুরুষ চারটি বৈধ বিয়ে করতে পারে, পঞ্চম একটিও করতে পারে। পঞ্চম বিয়ে করলে বিয়েটি বাতিল হয় না, শুধু দরকার পড়ে আগের একটি স্ত্রীকে এক-দুই-তিন করে তালাক দেয়া। মুসলমান পুরুষের জন্যে তার চারটি স্ত্রী সম্ভোগই শুধু বৈধ নয়, সে তার ক্রীতদাসীদের সাথেও সঙ্গম করতে অধিকারী।’
(৩)
'নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, কেউ কেউ নারী হয়ে ওঠে'। অর্থাৎ জৈবিকভাবে একটা শিশু স্ত্রী অঙ্গ নিয়ে জন্মায় এটুকুই প্রাকৃতিক সত্য। একটা শিশু কি জানে জন্মলগ্ন থেকে সে নারী না পুরুষ। পদে পদে তাকে হিজাব পরিয়ে, পুতুল খেলিয়ে, রান্নাবাটি ধরিয়ে দিয়ে, মেকআপ দিয়ে, খোলা আকাশ থেকে সরিয়ে ঘরে বন্ধ করে, সামাজিকভাবে তাকে মেয়েলি করে তোলা হয়। “ধর্ম মেয়েদের চিরকালের শত্রু। ধর্ম মেয়েদের শেকল পরায়। আমি কথামানবী স্বহস্তে ঈশ্বরের পূজা করতে গেলাম, ধর্ম বলল, পূজা পুরুষের অধিকার, ব্রাহ্মণ পুরুষের। আমি প্রতিবাদ করলাম, ধর্মের কবি তুলসীদাস বললেন, ‘ঢোল গাঁওয়ার শূদ্র পশু নারী ইয়ে সব হ্যায় তাড়নকে অধিকারী’ পুরুষ তালাক দিলে আমি খোরপোশ চাইলাম, ধর্ম বলল আল্লা নারীর খোরপোশের বিধান দেয়নি, আপনারা বলুন, কথামানবী কী করবে? কী করবে শাহবানু?” মিরান্ডা ডেভিজ তাঁর 'Thirdworld Women : Second Sex' বইয়ে যথার্থই লিখেছেন, “As they begin to recognise and identify the specific nature of their double oppression many women in the third world realise that when needed they may join the guerrila movement, participate in the economy, enter politics and organise trade unions, but at the end of the day they are still seen as women, second class citizens, inferior to men, bearers of children and domestic servants.”
কাজি নজরুল লিখেছেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই’। মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েদের অনেক সমস্যার মধ্যে একটা বড় সমস্যা হল সম্পত্তির সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। শরিয়তে বলা আছে ছেলে আর মেয়ে কখনই সম্পত্তির সমান অধিকার পাবে না। ছেলেদের থেকে মেয়েরা কম পাবে। আর আজকের এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও এই নিয়ম মানা হচ্ছে। 'আমি আমার দাদা, ভাইয়ের মত পড়াশোনা শিখেছি, কষ্ট করে বাইরে গিয়ে পড়েছি, হয়তো চাকরির তাগিদে আর পাঁচটা ছেলের মতোই বাইরে গিয়ে কষ্ট করে টিকে থাকার জন্য লড়াই করবো। অন্য ছেলেদের মতো সংসারের হাল ধরবো, আমার মা বাবাও হয়তো গর্ব করে অথবা চোখের জল (খুশির) ফেলে বলবে আমার মেয়ে, ছেলের থেকে একটুও কম না। পাড়া প্রতিবেশী সবাই বলবে ছেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে ওই মেয়ে। ও কম কি! কিন্তু সম্পত্তি ভাগের সময় তখন যে প্রমাণ করে ছাড়ে, হ্যাঁ মেয়ে তুমি কম। কম বলেই আমার সমান অধিকার নেই আমার নিজের বাড়িতে, নিজের সম্পত্তিতে। আমার মা বাবা যতই বলুন আমরা ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ করি না কিন্তু ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করতে গিয়ে সেই শরিয়তের প্রসঙ্গ তুলবে' (শাম্মী বিশ্বাস)। আজ মানুষের মানবিকতা কোথায় হারিয়েছে! হাদিসের অজুহাত দেখিয়ে যে নিয়ম চালু রেখেছে,শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের প্রতি বঞ্চনা কি চলতে দেওয়া যায়?
নজরুল দুঃখ করে বলেছিলেন:
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে
আমরা তখন বসে,
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি
ফেকাহ হাদিস চষে।’
ইসলামের সর্বশক্তিমান আল্লাহ পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। ইসলামের জন্মলগ্নে নারীর যে স্বাধীনতা ছিল- তা কিন্তু পরবর্তীকালে আর থাকেনি। ইসলামের বিজয়রথ যতই এগিয়েছে পুরুষরা নারীর অধিকারকে করেছে পদানত, করেছে বন্দী আর পরিণত করেছে হারেমে। এর ফলে নারী হয়ে উঠেছে পুরুষের কামনার বস্তু। হয়ে উঠেছে ফিতনা- বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার সময়ে নারীকে তারা বহন করেছে সাথে, কিন্তু তা একান্তভাবে উপভোগের জন্য। পুত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য আর দৈহিক তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। মুসলিম পুরুষের উত্তরাধিকার আরব পুরুষ যারা সম্ভোগ পরায়ন।
স্বয়ং এঙ্গেলস মার্কসবাদের সূত্র ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন --- "That woman was the slave of man at the commencement of society is one of the most absurd notions that have come down to us from the period of Enlightenment of the 18th Century."যে কোন দেশের, যে কোন ধর্মের নারীর সামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে প্রায় সমস্ত চিত্রটাই এক। হয়তো সামান্য কিছু ব্যতিক্রম নজরে আসে।
কিন্তু নারীর নারী হওয়া, তাকে মানুষ না ভাবা কিংবা নারীর অধিকার, সামাজিক মূল্যবোধ বা অবস্থান, পুরুষের সঙ্গে সম-অধিকারের প্রশ্ন উঠলেই ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদেরকে সমাজের নীচুতলার বাসিন্দা করে রাখা হয়েছে। যে সমাজের কথাই বলি না কেন প্রত্যেক সমাজেই নারীকে হীন চোখে দেখা হয়েছে। নারীকে নারী করেই রাখা হয়েছে, মানুষ হতে দেয়নি। মানুষ তৈরীর আঁতুড় ঘরে যে শিক্ষা, অর্থনীতি- সব কিছু থেকে তাদেরকে করেছে বঞ্চিত। তাই বলতে দ্বিধা নেই এই যে নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক তা গড়ে উঠেছে
স্বাভাবিক প্রেমের তাগিদে নয়, সংসারের তথা সন্তান উৎপাদনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে।
তথ্যসূত্রঃ
১) https://www.census2011.co.in/religion.php
২) https://en.m.wikipedia.org/wiki/Sachar_Committee
৩) https://sksew.com/welcome/singlepost/muslim-women-education-patriarchy-india
৪) তদেব, মেধাজন্ম, কথামানবী, তদেব, পৃষ্ঠা-১০২
৫) তদেব, পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫
৬) ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান, পৃঃ ৩৩-৩৮
৭) হুমায়ূন আজাদ, নারী, আগামী প্রকাশনী
৮) ফরহাদ মজহার, বোরখা, এবাদতনামা
৯) Miranda Davies, Third World, Second Sex Woman's Struggles and National Liberation
১০) Friedrich Engels Origin of the Family, Private Property, and the State, March-May, 1884